হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:
টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ করিডোরে মিয়ানমার থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গবাদিপশু আসছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও স্থানীয় আমদানীকারক ও গবাদিপশু ব্যবসায়ীগণ কুরবানীর চাহিদা পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন। অন্য বছরের চেয়ে এবারে মিয়ানমার থেকে গবাদিপশু আসছে বেশী। আমদানীকৃত গবাদিপশু ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হচ্ছে।
টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ করিডোর দিয়ে আসা মিয়ানমারের গবাদিপশু নিয়ে টেকনাফ গোদারবিল মাদ্রাসা সংলগ্ন মাঠ, সাবরাং ইউনিয়ন কমপ্লেক্স, শাহপরীরদ্বীপের নাফনদীর বেড়িবাধ ও পুরাতন বাজারের বেশ কয়েকটি স্থানে পশুর হাট জমে উঠেছে।
সেদেশের সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন থাকলেও দু’দেশের সু-সম্পর্কের কারনে পশু আমদানীতে কোন প্রভাব পড়ছে না। আমদানীকৃত পশুগুলো সরবরাহ হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিশেষ করে সমুদ্র ও আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকায় এসব পশু নির্বিঘেœ আমদানী করতে সক্ষম হচ্ছেন এবং কোরবান উপলক্ষে গরু-মহিষের চাহিদা থাকায় মিয়ানমার থেকে পশু আনতে ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হয়েছেন।
জানা যায় চলতি ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে এ পর্যন্ত মোট ১৩ হাজার ৪৩৭টি গবাদিপশু আমদানি খাতে ৬৭ লাখ ১৭ হাজার ৯০০ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ স্থল বন্দর শুল্ক বিভাগ। এর মধ্যে চলতি আগস্ট মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত ৬ হাজার ৮৪৫টি গরু এবং ১ হাজার ২৫৭টি মহিষ আমদানি খাতে ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ টাকা এবং জুলাই মাসে ৪ হাজার ৬৭১টি গরু, ২ হাজার ৭টি মহিষ ও ২টি ছাগল আমদানি করে আদায় হয়েছে ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এভাবে গবাদি পশু আমদানি অব্যাহত থাকলে স্থানীয় বাজারে পশুর সংকট থাকবে না বলে মনে করছেন গবাদিপশু এবং আমদানীকারকরা। পর্যাপ্ত কোরবানির পশু মজুদ থাকায় বাজারে মূল্যও ক্রেতাদের ক্রয় সীমার মধ্যে থাকবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
টেকনাফ শুল্ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে এ পর্যন্ত মোট ৬ হাজার ৮৪৫টি গরু, ১ হাজার ২৫৭টি মহিষ ও ৩টি ছাগল পশু আমদানি করা হয়েছে। এতে ৪০ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে ৬ হাজার ৬৭৮টি গবাদিপশু আমদানী করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৭১টি গরু, ২ হাজার ৭টি মহিষ এবং ২টি মাত্র ছাগল আমদানি করে রাজস্ব আয় হয়েছে ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া সদ্যসমাপ্ত ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৫৪ হাজার ৪৯৬টি গরু, ১২ হাজার ৩৯৫টি মহিষ ও ৪৫টি ছাগল আমদানি করে ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৫৭ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়। যা বিগত ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে প্রাপ্ত রাজস্ব ১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৪৮ হাজার টাকার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে গবাদিপশু আসা রোধে ২০০৩ সালে ২৫ মে শাহপরীরদ্বীপ করিডোর চালু করা হয়। এতে প্রতি গরু-মহিষের জন্য ৫০০ টাকা ও ছাগল ২০০ টাকা হারে রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। বিজিবি ও শুল্ক বিভাগের সহায়তায় সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে থাকেন আমদানীকারকরা। তবে করিডোর প্রতিষ্ঠার এক যুগ সময় পার হলেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামোসহ কোন স্থাপনা গড়ে উঠেনি। ফলে আমদানীকৃত গবাদিপশুর ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
১৯ আগস্ট বড় ৬টি কাঠের ট্রলারে করে ৭১১টি গরু-মহিষ নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। পরে নাফ নদীর জেটি দিয়ে গরুগুলো করিডোরে নামানো হয়। করিডোরের খোলা মাঠে দেখা যায় মিয়ানমার থেকে আনা আরও কয়েক শ গরু-মহিষ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকজন ব্যবসায়ী পশু কেনার জন্য দরদাম করছেন। ২১ আগষ্ট সোমবার মিয়ানমার থেকে শাহপরীরদ্বীপ করিডোরে প্রায় ৫০০ গবাদিপশু আমদানী করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩১টি গরু ও ৫৮টি মহিষ রয়েছে। রবিবার ২০ আগস্ট ৫টি ট্রলারে ৫ শতাধিক গবাদিপশু আমদানী করা হয়। আমদানীকারকরা হলেন মাওঃ বোরহান উদ্দিন, আব্দুল্লাহ মনির, আবু ছৈয়দ মেম্বার, শফিউল ইসলাম, মোঃ শরীফ, মোঃ আলমগীর ও মোঃ আবদুল্লাহ। তাঁরা জানান, নাফনদী ও সাগরে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বাধা না থাকলে কোরবানের আগে আরও ৩০ থেকে ৪০ হাজার গবাদিপশু আমদানি করা যাবে। তবে মিয়ানমার থেকে গবাদি পশু বোঝায় ট্রলার গুলোকে শাহপরীরদ্বীপ করিডোরে আসতে বঙ্গোপসাগর ও নাফনদী দিয়ে ১২ ঘন্টার বেশী সময় পাড়ি দিতে হয়। এতে সাগর উত্তাল থাকলে পশুবাহী ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে মাঝে মধ্যে। এতে অনেক পশু ট্রলারে মারা যায়।
টেকনাফের গবাদিপশু ব্যবসায়ী, পৌর প্যানেল মেয়র-২ সাংবাদিক আবদুল্লাহ মনির জানান, দেশে গবাদি পশুর চাহিদা থাকায় মিয়ানমার থেকে পশু আমদানী আগের তুলনায় কয়েক গুন বেড়ে যায়। বর্তমানে ভারতের গরু আসা শুরু হওয়ায় টেকনাফে বাইরের গবাদিপশু ব্যবসায়ীরা এখন কম আসছেন। এর পরও পশুর চাহিদা ও দাম রয়েছে বলে জানান। শাহপরীরদ্বীপে ব্যাংক ও শুল্ক বিভাগের শাখা না থাকায় নানা সমস্যা পোহাতে হয়। তাছাড়া গবাদিপশু ট্রলার থেকে নামানোর জন্য নেই কোন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। উপরন্ত গত ৫ বছর ধরে শাহপরীরদ্বীপ সড়কটিও বিছিন্ন। যার ফলে যাতায়ত ও পশু পারাপারে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
টেকনাফের গবাদিপশু ব্যবসায়ী মো. শহীদুল ইসলাম জানান, গত ৭ দিনে তাঁরা কয়েকজন ব্যবসায়ী মিয়ানমার থেকে ২ হাজার ১৪৮টি গরু ও ২৮৪টি মহিষ আনেন। এসব পশু কিনে ব্যবসায়ীরা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, প্রতিটি গরু ও মহিষের বিপরীতে ৫০০ টাকা করে রাজস্ব পরিশোধ করতে হয়। শাহপরীরদ্বীপের পশু ব্যবসায়ী মৌলভী নুরুল হক বলেন, করিডোরে তিন মণ ওজনের একটি গরুর দাম পড়ছে ৪৮ হাজার টাকা। চার মণ ওজনের গরু ৬৫ হাজার ও পাঁচ মণের বেশি ওজনের গরু ৮৫- ১লাখ ২০ হাজার টাকা। এসব গরু কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকার হাটে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রয় করা হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের পশু মোটাতাজা হওয়ায় ব্যবসায়ীরা চড়া দামে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।
গাবতলীর ব্যবসায়ী ফরিদুল আলম প্রায় ৬৫ লাখ টাকায় কিনেছেন ১১০টি গরু। প্রতিটি গরুর ওজন তিন থেকে চার মণ। তিনি বলেন, গড়ে প্রতি গরুর দাম পড়েছে ৬০ হাজার টাকা। ট্রাক ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করে ঢাকায় পৌঁছাতে প্রতিটি গরুর দাম দাঁড়াবে গড়ে ৭০ হাজার টাকা। প্রতিটি গরু বিক্রি হবে ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকারও বেশি দামে।
আরেক ব্যবসায়ী মুজিবুর রহমান বলেন, প্রতিবছর কোরবানির পশুর হাটে তিনি ভারতের গরু বিক্রি করতেন। এবার তিনি টেকনাফে এসেছেন। গত এক সপ্তাহে তাঁরা কয়েকজন ব্যবসায়ী টেকনাফ করিডর থেকে তিন শতাধিক গরু কিনে ঢাকায় পাঠিয়েছেন।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনর্চাজ (ওসি) মোঃ মাইন উদ্দিন খান জানান, কোরবানীর সময় হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা শাহপরীরদ্বীপ করিডোরে গবাদিপশু কিনতে আসছেন। তাই পশু সরবরাহে পথে কোনো ধরনের চাঁদাবাজির মতো অপরাধ যেন না হয় এবং জাল টাকা প্রতিরোধের জন্য নজরদারী বাড়ানো হয়েছে। এ লক্ষ্যে পুলিশের টিম কাজ করছে।
টেকনাফ শুল্ক কর্মকর্তা একেএম মোশারফ হোসেন জানান, গত অর্থবছরে ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও গবাদিপশু ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় পশু আমদানিতে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে। করিডোরে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও যাতায়াতের সু-ব্যবস্থা হলে আগামীতে আরও বেশি রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে।
পাঠকের মতামত: